আমার টুকটুকি বাচ্চা

গত রোজার সময় আল্লাহ রুহটা হঠাৎ করেই পাঠিয়ে দিলো আমার মধ্যে। ভাবলাম অনেক কিছু জানি, যেহেতু দু বাচ্চার মা। তাই ডাক্তারের কাছে ও গিয়েছি পুরো সময়ে খুব কম। যেখানে আগের দুই বার প্রতি মাসে চেকাপে যেতাম। মনে হোচ্ছিল অবহেলা করছি কিনা!!

সাথে সাথে প্রতিদিনকার অফিস তো আছেই। শরীর যেমন ই থাকুক, ছুটি নেইনি এক দিন ও। শেষ চেকাপে সি-সেক এর তারিখ দিয়েছিল ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৯। ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত কলেজে গিয়েছিলাম, যেহেতু দ্বাদশ শ্রেণির দায়িত্বে ছিলাম। ২৯ তারিখ আম্মু ঢাকায় আসায় ৩০ তারিখ হাসপাতালে যাই। ডাক্তার ব্যস্ত থাকায় ৩০ তারিখ আর কিছু করেনি।

বাচ্চাদের বাবাকে বোঝাতে চেষ্টা করছিলাম যাতে আরো ২/৩ দিন দেরি করে ( ইডিডি আরো পরে ছিল)। জানুয়ারি ২ তারিখে আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল, সেটা শেষ করে যাবো ভাবছিলাম। কিন্তু প্রচন্ড কাজের প্রেশারে টুকটুকি মুভ করা কমিয়ে দিয়েছিল। তাই আর দেরি না করে ৩১ডিসেম্বর সকাল ৯ টায় সে পৃথিবীতে চলে আসে। হাসপাতলে আমার সাথে আম্মু আর তাদের বাবা ছিল। ব্লাড দেয়ার জন্য প্রিয় সহকর্মী রুখসান ও ছিল।

নায়রাহ ও নাওঈদ তাদের নূপুর আন্টি ও সাহায্যকারী মেয়েটা র সাথে বাসায় ছিল। বিকালে বাসার সবাই মিলে নুবাঈদকে দেখতে এলো। সন্ধ্যায় ওরা ফিরে যাওয়ার সময় বাসার চাবি ভুলে রেখে চলে যায়। তাই তাদের বাবা দৌড়াতে দৌড়াতে আবার চাবি দিতে চলে গেল বাসায়।

এসময় হাসপাতালের বেডে আমি আধা শোয়া হয়ে স্যুপ খাচ্ছিলাম। নুবাঈদ পাশে আরেকটা বেডে শোয়া। রুমে একটা দুইটা মশা ঘুরছিল। ভুলে তার জন্য ছোট মশারিটা বাসা থেকে আনা হয় নাই। তাই পাতলা একটা ওড়না দিয়ে ওকে ঢেকে রাখা হয়েছিল খুব কায়দা করে যাতে করে ওর মুখের অংশটাতে ওড়না উঁচু হয়ে থাকে। আম্মু একটু পরপর চেক করে দেখতো ঠিক আছে কিনা। কিন্তু এদিকে বাচ্চাদের সাথে সন্ধ্যায় আম্মু বাসায় চলে গেল। চাবি ফেলে যাওয়াতে ওদের বাবা যখন পিছে পিছে যায়, তখন নুবাঈদের মুখে ওড়না দিয়ে যায়।

রুমে সেই মুহূর্তে আমি একা। হঠাৎ দেখি হাত নাড়াতে গিয়ে সে ওড়নাটা মুখের উপরে ফেলে দিয়েছে। বাচ্চাটা সমানে দুই হাত নাড়ছে, ছটফট করছে কিন্তু মুখ দিয়ে কোন শব্দ করছে না। আমি দেখতে পাচ্ছি সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। তার নাকে মুখে ওড়না পড়ে আছে। আমি কোনভাবেই নিজেকে বিছানা থেকে এক চুলও নাড়াতে পারছি না; হাতে স্যালাইন, ক্যাথেটার লাগানো।
একটু আগের পেট কাটা প্রসূতি একজন মায়ের নড়াচড়া করার মত কোন অবস্থা নাই।

আশেপাশে কেউ নাই যে চিৎকার করে কাউকে ডাকবো। কেবিনের দরজা বন্ধ। তাদের বাবাকে ফোন দিলাম ,সে তখন হাসপাতাল থেকে অনেক দূরে। আমি সমানে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। মনে হলো একটু আগে মাত্র বাচ্চাটা পৃথিবীতে এলো আর এখনই বোধহয় চোখের সামনে মারা যাচ্ছে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে নার্সদেরকে ডাকছিলাম। কিন্তু কেবিনের বাইরে খুব বেশী আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল না। মরিয়া হয়ে তখন স্যুপ খাওয়ার চামচটা দিয়ে বেডের স্টিলের রেলিংটাতে জোরে জোরে বাড়ি দিচ্ছিলাম। আর চিৎকার করে রুম নাম্বার বলছিলাম যাতে করে আমার রুমে কেউ আসে। প্রায় ৭/৮ মিনিট চিৎকার করার পর নার্স এসেছিল। তারপর তার মুখের উপর থেকে কাপড়টা সরালো। মনে হচ্ছিল এ যাত্রা বোধহয় বাচ্চাটা শেষ হয়ে গেল , কারণ সে কোন শব্দ করছিল না।আর আমি কেঁদে বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছিলাম।

জন্মের শুরুতে তাকে বেশ সংগ্রাম করতে হয়েছে। জীবনের বাকিটা সময় সে যেন খুব সহজ-সরল স্বাভাবিক ভাবে পার করতে পারে। আমার টুকটুকি বাচ্চাটা নেক হায়াত নিয়ে বেঁচে থাকুক আল্লাহর পছন্দের মুমিন বান্দা হিসেবে। তার বছর পূর্তিতে দোয়া এবং প্রাণ ভরা ভালোবাসা।