একদিন গরুর হাটে

অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষার শেষ পরীক্ষাটি ছিল আজ। ছানাপোনারা ব্যাপক আনন্দিত। আজকের দিনে তাই যা যা আবদার করেছে, মোটামুটি সেগুলো পূরণ করার চেষ্টা করলাম। তাদের বেশ কিছু বায়নার মধ্যে একটা ছিল গরু হাত দিয়ে ধরতে চাওয়া, আদর করা। কেননা গত দুইদিন ধরে ওরা স্কুলে আসতে যাইতে রাস্তার উপরে গরু দেখছে।

বাসা থেকে তাদের স্কুল এবং আমার অফিস যাওয়ার পথ গত দুইদিন ধরে বন্ধ হয়ে আছে গরুর হাট বসার জন্য। তাই স্কুলে যাওয়ার সময় ঘুরিয়ে পেচিয়ে অন্য পথ দিয়ে যাওয়া লেগেছে। পথে যেতে যেতে তারা টুকটাক গরু দেখতে পেয়েছে। তাই তাদের আবদার তারা গরু ধরতে চায়!!

অফিস শেষে বের হয়ে তাই বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলাম। যে পথ গরুর হাটের জন্য বন্ধ রেখেছে সেই পথে আল্লাহর নামে চলিলাম। এত বছরের জীবনে কখনোই গরুর হাটে যাই নাই। আজ বাসায় যাওয়ার পথ হেটে গেলাম, তাই মাঝখান থেকে প্রথমবারের মতো গরুর হাট পরিদর্শনও হয়ে গেল। স্কুল কলেজ খোলা থাকার কারণে এখনো পুরোপুরি গরুর হাট ভরে উঠে নাই। তবুও আজকে আমরা প্রায় কয়েক হাজার গরু দেখে ফেলেছি।

হাটে ঢোকার শুরুতেই দেখলাম কুলফি আইসক্রিম নিয়ে আইসক্রিম মামা বসে আছে। পোলাপাইন কে বুঝাইলাম ঠান্ডা মাথায় পথ চলতে হবে । আইসক্রিম খাও মাথা ঠান্ডা রাখো। দৌড়াদৌড়ি করার কিছু নাই। গরু দেখার শখ করেছো, শখ মিটিয়ে নাও। তোমাদেরকে গরু কিছু বলবে না, পিচ্চি পিচ্চি বাচ্চাদেরকে গরু পাত্তা দেয় না। তোমরা শুধু দুই সারি গরুর মাঝ দিয়ে সোজা হয়ে হাঁটবা।

পথ চলতে শুরু করার পর আমার কন্যা যে গরু দেখে, সেই গরুই আদর করতে মন চায়। মানে যে গরুটা বসে আছে গুতা দিতে পারবে না। এমন গরু দেখামাত্র সে ছুটে যায় শুধু আদর করতে। নাওউদের আবার প্রচুর ভয়। সে দুর থেকে দেখলো, আদর টাদরের ধার ধারে নাই।

পথ চলতে চলতে দেখলাম পাশাপাশি দুই গরু একজন আরেকজনকে গুতা দিয়ে ফেলে দিচ্ছে। গরুর মালিকরা দেখি কিছু বলে না, চুপচাপ দেখতেছে …. ঘটনা বুঝলাম না। অনেকগুলা গরু হাটে মাত্র আজি এসেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রায় ১০-১২ ঘন্টা জার্নি করে, দাঁড়িয়ে থেকে এসেছে। গরু গুলো বেশ ক্লান্ত। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। অনেক গরুকে এত ছোট করে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে যে তারা বসতে চাইলেও বসতে পারছে না!! 🥹 ওদের মালিকগুলা এগুলো খেয়াল করছে না কেন?

পথ চলতে চলতে দেখলাম সুন্দর একটা লাল গরু একটা ছেলের গায়ে মাথা দিয়ে রেখেছে। ছেলেটার নাম সাব্বির। বাবার সাথে সিরাজগঞ্জ থেকে এসেছে। প্রায় ১০০ টা গরু এনেছে ওরা। কিন্তু এই গরুটা ওকে খুব পছন্দ করে। গরুটা ওর গায়ের উপরে মাথা দিয়ে রাখল তো রাখলই। এরপর দেখলাম জিহ্বা দিয়ে ছেলেটার হাত চেটে দিচ্ছে বারবার। ছেলেটার চোখ ছল ছল করছে। ওর লাল গরুটার দাম ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। আমরা ওকে আদর দিয়ে চলে আসলাম।

আমরা আমাদের বাসার পথে সোজা হাঁটতে লাগলাম। ডানে বামে আরো অনেক গরু। অন্য কোন দিকে আর যাইনি। সোজা পথের এক জায়গায় দেখলাম বিশাল একটা গরু। দাম ১৭ লক্ষ টাকা 😲। সিরাজগঞ্জ থেকে এসেছে। বিশাল একটা ফ্যান দিয়ে ওকে বাতাস দেয়া হচ্ছে। ওই গরুটা দেখার জন্য চারপাশে মানুষজন ভিড় করে আছে। গরুর সাথে কেয়ারটেকারের সে কি ভাব। বাজারের এটাই নাকি আজকের সবচেয়ে বড় গরু। কাল-পরশু হয়তো আরো বড় আসতে পারে।

আরেকটু এগিয়ে যেতে দেখলাম আর একটা সুন্দর লালচে সাদা গরু। দাম পাঁচ লাখ টাকা। কুষ্টিয়া থেকে ১২ ঘন্টা জার্নি করে এসেছে , বেশ টায়ার্ড। তাকেও আদর করে দিল নায়রাহ।

এবার আস্তে আস্তে রাস্তার প্রশস্ততা কমতে লাগলো এবং দুই সারি গরুর মাঝখানে একজন মানুষও ঠিকভাবে যাতায়াতের রাস্তা রইল না। এমনটা আশা করি নাই! 🥴 এতটা পথ হেঁটে আসলাম এখন আবার উল্টা দিকে ফেরত যাবো হেঁটে হেঁটে, এটা চিন্তা করে তাদেরকে বুঝিয়ে বললাম কিছু হবে না। ওদের মাঝখান দিয়েই আমরা যাব, ওরা তোমাদের কিছু করবে না।

এরপর শুরু হল ঘটনা। আস্তে আস্তে হাটা দিলাম গরুর চিপা দিয়ে, এর মধ্যে কালো এক গরু দৌড়ে দৌড়ে আসছে। আমি আর নাওঈদ ছিটকে একদিকে , নায়রাহ চলে গেল আরেক দিকে। বেচারা দুইজন কাদকাদো হয়ে গেল। যাইহোক কোনমতে এই দৌড়ানি সামলানো গেল। একটু একটু করে আগাতে আগাতে দেখি এক স্তূপ গোবর এবং তার ডানে গরু বামেও গরু। আবার সামনে দিয়ে একটা মোটর বাইক সেই গোবর স্তুপ পার হয়ে আসার চেষ্টা করছে। আস্তে করে আমরা দুই গরুর মাঝখানে একটা জায়গায় দাঁড়ালাম। ওমা, দেখি গরু আমাকে গুতা দেওয়ার চেষ্টা করছে! 😵‍💫 পোলাপাইন কে এক মুখে সাহস দিচ্ছি কিছু হবে না। আরেক দিকে স্লো মোশনে কিচ-কিচ করে চিৎকার করা শুরু করলাম। গুতা দিলো রে ভাই😭 গরুওয়ালা যতই তার রসি ধরে টানে, গরু ততই আমাদের গুতা দিতে আসে। আমাদের সামনে গোবর স্তুপ এবং একটি মোটরসাইকেল , দুই পাশে গরু। আমরা একটি ব্লকে আটকা পড়েছিলাম। মোটরসাইকেল যখন পার হয়ে গেল কোন রকমে ছানাদের টেনে বের করে আবার আগাতে শুরু করলাম। এবার সামনে থেকে পোলাপাইন বলে উঠলো, আন্টি সাবধান। একটা গরু ছাড়া পেয়ে দৌড়াচ্ছে। দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে এরপর কোনরকমে চোখ বন্ধ করে মনে হয় বাকি হাট পার হয়ে আসলাম। ছানাদের বলতে বলতে আসলাম, কিছু হবে না, ওরা আমাদের কিছু করবে না😐 সামনের দিকে তাকায়ে শুধু হাটো। ওরা তোমাদের গুতা দেবে না। বাচ্চা দুইটা প্রায় কেঁদে ফেলে অবস্থা, আমার অবস্থা- ছাইড়া দে মা, কাইন্দা বাঁচি।

অবশেষে কিছুক্ষণের মাঝে সেই গরুর হাট অভিযানের সমাপ্তি ঘটলো। ধারণা করছি, আপাতত পুত্র কন্যার গরুর হাট পরিদর্শনের খায়েস মিটেছে। আর আমার অভিজ্ঞতার ভান্ডারে নতুন ঘটনা সংযুক্ত হয়েছে।

আগামীকাল মহাসমারোহে এই গরুর হাট পাড়ি দিয়ে বাসা থেকে বের হতে হবে। আমাদের গলির সামনে মেইন রাস্তা থেকেই বিশাল গরুর হাট। আজ এবং কাল আরো অনেক অনেক গরু আসবে।
এবং গাড়ি চলাচল জায়গায় জায়গায় বন্ধ আছে। নির্দিষ্ট গন্তব্যে সময়মতো পৌঁছানো একটি চ্যালেন্জ। আগামী কালকের জন্য দোয়া প্রার্থী।

#একদিনগরুরহাটে