মহামারী এবং পরিবর্তিত জীবনযাত্রা

করোনা মহামারী আমাদের চলমান জীবনে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে। কম বেশি সবার জীবনে প্রভাব পড়েছে। মানুষজন আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে তার পরিবারের আপনজনকে হারিয়েছে, কেউ তার চাকুরী হারিয়েছে, কারো ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। বেশিরভাগ বাচ্চাদের পড়াশোনা অনিয়মিত হয়ে গেছে- স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকার কারণে। বাচ্চাদের ডিভাইসের প্রতি আসক্তি বেড়েছে। এভাবে একেকজনের জীবনে একেক রকম করে করোনা তার ছাপ রেখে যাচ্ছে।

এই মহামারী আমার জীবনযাত্রাতেও বেশ প্রভাব ফেলেছে এবং তা ইতিবাচকভাবে। করোনা আক্রান্ত হয়ে শারীরিক সক্ষমতা বেশ নড়বড়ে হয়ে গেছে। এটা ছাড়া করোনা কেমন প্রভাব ফেলেছে আমার জীবনে??
সেটাই ভাবছিলাম গত ক’দিন ধরে।

একটা সময় প্রায় প্রতি দু এক মাস পর পর বোরকা, আবায়া, কুর্তি এসব কিনতে খুব ভালো লাগতো। শখ বলতে এই একটা জিনিসই ছিল। অন্য তেমন কিছু কেনাকাটা করতে কখনো খুব বেশি আগ্রহ ছিল না। ছাত্রজীবনে নিজে নিজেই বোরকা ডিজাইন করে বানাতাম। সময়ের সাথে সাথে ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছে, আবার অনলাইনেও পছন্দমত বোরকা গুলো সহজলভ্য হয়েছে। তাই অনলাইনে মোটামুটি পছন্দ হওয়া মাত্রই অর্ডার করে ফেলতাম। এই শখ পুরনে কখনোই আবার কারো উপর নির্ভরশীল হইনি। একান্তই নিজের শখ, তাই নিজেই সেটা পূরণ করার চেষ্টা করেছি। একটা সময় দেখা গেল পুরনো বোরকা গুলো পরা হচ্ছে না, ছানাপোনার মা হওয়াতে অনেক শখের বোরকা গুলো কোনটা আবার গায়ে লাগছে না, কোনোটা হয়ত খুব বেশি পছন্দ, তাই অকেশনালি দু এক বার পরে যত্ন করে তুলে রেখে দিয়েছি। এভাবে দেখা গেল আমার আলমারির ভর্তি বোরকা। অনেকগুলো দিয়ে দিয়েছি এদিকে সেদিকে, তবুও আলমারিতে প্রচুর রয়ে গেছে। ইউনিভার্সিটিতে পরা আবায়াগুলো পরে এখোনো অফিসে যাই। একটাও নষ্ট হয়ে যায় নাই, ছিড়ে ও যায় নাই। তাই নতুন কিনলে পুরনোগুলোর সাথে আরো বোরকা যোগ হতেই থাকে।

করোনা যখন শুরু হয়েছে তখন বাসা থেকে মোটামুটি প্রায় একবছর বের হওয়া বন্ধ ছিল। রেস্ট্রিকটেড এরিয়াতে থাকার কারণে খুব প্রয়োজনীয় কারণে ও মাঝেমাঝে বের হতে পারিনি। তখন উপলব্ধি হলো আমার আসলে এত বেশি বাহিরে যাবার পোশাকের প্রয়োজন নাই। এরপর থেকে আত্মসংযমী চেষ্টায় আছি। এখোনো অনেক অনেক আবায়া, বোরকা দেখি আর পছন্দ করি। অপচয় হবে ভেবে এখন আর কোন কিছুই কেনা হয় না খুব একটা, আলহামদুলিল্লাহ। মনের কেনাকাটাই আসল কেনাকাটা 😑। করোনা আমাকে কিছুটা মিতব্যয়ী হতে সাহায্য করেছে।

স্বাভাবিক সময়ে প্রতি মাসে দু একবার কোথাও না কোথাও বেড়াতে বের হোতাম। হোক সেটা কোন পার্ক, বেড়ানোর জায়গা, আত্মীয়স্বজনের বাসায় যাওয়া ইত্যাদি। করোনাকালীন সময়ে পুরো এক বছর কোথাও যাওয়া হয়নি। এই সময় চারটি ঈদ ঢাকার বাসায় একা করেছি। সৌভাগ্যক্রমে শেষ কুরবানী ঈদ আব্বু আম্মু ভাই বোনের সাথে একত্রে পালন করেছি ।

যখন একা একা মানুষ জন ছাড়া ঈদগুলো করেছিলাম, তখন মনে হত যেন প্রবাসে আছি। কেউ আসছে না আমাদের বাসায়, আমরা কারো বাসায় যাচ্ছি না। কোন আপন জনের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ নাই। ঠিক যেন সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে পরিবার পরিজন ছেড়ে বসবাস করছি রাজধানীতে। করোনাকালীন সময়ে প্রবাস জীবনে একাকী থাকার যে অনুভূতি সেটা বেশ ভালোই অনুভব করেছি।।

লকডাউনের সময়ে পিলখানার ভিতরে বুয়া আসা বাতিল হয়ে গিয়েছিল। আর সাহায্যকারী মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিবে তাই সেও চলে গিয়েছিল। পিঠাপিঠি তিন বাচ্চা, পাশাপাশি অনলাইন ক্লাস এবং সংসারের কাজ করতে করতে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। বাচ্চাদের বাবা অনেক সাহায্য করেছে। কিন্তু তবুও মায়ের কাজ তো অন্য কেউ করা সম্ভব না।

সারাদিন কাজ করতে করতে নিজেকে রোবট মনে হতো। কিছুক্ষণ পর পর শুয়ে থাকতে হতো হাত,পা, কোমর ব্যথার জন্য। একটু পর পর বিশ্রাম নিয়ে আবার কাজ শুরু করতাম শর্টকাটে যতখানি পারা যায়। কাজ সহজ করার জন্য যতরকম গেজেট ব্যবহার করা যায় চেষ্টা করেছি তা ব্যবহার করতে। তবু ঘরের সব কাজ করতে করতে নিজেকে মানুষ মনে হতো না, মনে হতো ‘আই এম গ্রুট’ ওই কথা বলতে পারা গাছের মত হয়ে গেছি।

প্রবাসে আমাদের আত্মীয় স্বজন,বোন , ভাবি যারা আছে তারা কিন্তু ঠিকই বাচ্চাকাচ্চা লালন-পালন একা হাতেই করছে কোন সাহায্যকারী ছাড়া। যদিও তাদের জীবনযাত্রা হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের চাইতে বেশ সহজ। তবু তারাও একা হাতে সংসার করছে।

আমাদের দেশে কোন সাহায্যকারী ছাড়া কাজ করাটা বেশ কষ্টকর এবং অনেক ক্ষেত্রে যেন অসম্ভব মনে হয়। আমার কাছে এখন আর কোন কিছুই অসম্ভব না, আলহামদুলিল্লাহ। সারাদিন সংসারের সব কাজ করে, সারারাত আবার অফিসের কাজ করতে হোত। সবকিছু সামলে নিয়েছি, এখনো সামলাচ্ছি আলহামদুলিল্লাহ। গত দু’মাস আগে ছুটা কাজের জন্য একজন সাহায্যকারী রাখতে পেরেছি বাসা পাল্টানোর সুবাদে, তাই কাজ এখন কিছুটা সহজ হয়েছে আগের চাইতে।
উপলব্ধি হলো সাহায্যকারী বুয়া ছাড়া কাজ করা কষ্টকর, তবে অসম্ভব না।

আগে বিউটি পার্লারে যাওয়া হতো, শখের বশে। বছরে হয়তো এক দুবার। গত প্রায় দুই বছরে একবারও যাওয়া হয়নি। তার মানে এটা কোন মৌলিক কাজের মধ্যে পড়ে না। পার্লারে না যাওয়াতে জীবন-যাত্রার কোন ধরনের পরিবর্তন হয় নাই। ঘরের রাজার কাছে ঘরের রানি হয়েই আছি। পার্লার বিউটিফিকেশন এ ঘরের রাজার তেমন কিছু যায় আসে না। তথৈবচ।

নুবাঈদের তখন আটাশ দিন বয়স যখন আমি অফিসে জয়েন করেছিলাম ২৮ জানুয়ারি, ২০২০। আগের দুবার মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটিয়ে ফেলার কারণে নুবাঈদের সময় আর কোনো ছুটি পাইনি। কলেজ কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার কারণে এবং কলেজ প্রাঙ্গণে বাসা হওয়ার কারণে অফিস কনটিনিউ করতে পেরেছিলাম। এরপর মার্চ ১৭ থেকে অফিস বন্ধ। অনলাইনে ক্লাস করেছি, তবু এতো ছোট পুত্রকে রেখে অল্প সময়ের জন্য ও অফিস করা লাগেনি। বরং সে তার মাকে সবচেয়ে বেশি পেয়েছে। এখন সুপার গ্লুর মতো আটকে থাকে মায়ের সাথে সারাদিন। দেখতে দেখতে প্রায় দু বছর বয়স হয়ে যাচ্ছে তার। ( মোবাইলে ব্যস্ত মম্মা, এই সুযোগে একটা গ্লাস ভেঙ্গে ফেলেছে 🥴)

হোম অফিসের কাজে আমরা বাবা-মা দুজনই বাসায় থাকাতে, বাচ্চাদের দেখাশোনা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়নি।

এই সময়ে পৃথিবীতে অনেক কিছু ঘটে গেছে ইতিবাচক ও নেতিবাচক। সামনে তাই ঘটুক তা যেন উম্মাহর জন্য কল্যাণকর হয়। সবার জীবনে যেন ইতিবাচক পরিবর্তন হয়।

মহামারী, লকডাউন, করোনা আক্রান্ত, বন্দী জীবন….. আলহামদুলিল্লাহ বেঁচে আছি, ভালো আছি। আবার কলেজ শুরু হতে যাচ্ছে। দৈনন্দিন কাজকর্মে আবার পরিবর্তন আসবে। জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, আশায় দিন গুনছি।

(আমার অতি পছন্দের মালাই চা। দিনে দুইবার খাওয়ার অভ্যাসটা এখনো ছাড়তে পারছিনা😑 লকডাউন ইফেক্ট)