স্বপ্নভঙ্গের বেদনা এবং….

ছোটবেলা থেকেই মেয়েটির একরাশ স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়েছে যে, সে বড় হয়ে আর্কিটেক্ট হবে। তার খুব আশা-আকাঙ্ক্ষা , স্বপ্ন এটা নিয়ে। নিজেকে সে সেভাবেই গড়ে তুলেছে।

পড়াশোনায় তার ফলাফল বেশ ভালো। তাই তার লক্ষ্যের দিকে আত্মবিশ্বাসও বেশ মজবুত। এইচএসসি পরীক্ষা তে ভাল ফলাফলের পর যখন সে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং আশানুরূপ কোথাও চান্স পায়নি, তখন থেকেই তার স্বপ্ন ভঙ্গ হওয়া শুরু করে। অবশেষে সে চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি তে অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী হওয়ার সুযোগ পায়। বেশ ভালো একটা সাবজেক্টে ভর্তি হয়েও তার হীনমন্যতা কোনভাবেই দূর হয় না। সে তো নিজেকে মনে করেছে যে, সে ভবিষ্যতের একজন ইঞ্জিনিয়ার/আর্কিটেক্ট হবে। তার লক্ষ্যের সাথে এই পড়াশোনা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না। ফলাফলে প্রথম বর্ষে থাকাকালীন সময়ে তার নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়।

বেশ কিছু সময় ধরে তার চিকিৎসা চলতে থাকে। পড়াশোনায় একটা ইয়ার লস করে পরের বছর আবার সেই একই সাবজেক্টে ভর্তি হয়। আবারও একই দশা। এডজাস্ট করতে পারছে না। ভবিষ্যৎ আর্কিটেক্ট অর্থনীতি পড়ে কি করবে!!!

পরে জাতীয় ইউনিভার্সিটির আন্ডারে তাকে বিকমে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়, বাসার পাশেই একটি কলেজে। বাবা-মার ইচ্ছা মেয়ে সুস্থ থাকুক, পড়াশোনার দরকার নাই। কোন রকম একটা সার্টিফিকেট পেলেই হবে, না হলেও সমস্যা নাই। কিন্তু তার তো স্বপ্ন ভেঙে গেছে। সে তো কোনভাবেই কারো সাথে, কোন কিছুর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। ছোটবেলা থেকেই পরিবার – সমাজ তার স্বপ্নের ভিত এতই মজবুত ভাবে গড়ে তুলেছিল যে সেটা পূরণ না হওয়াতে সে গ্লাসের মত মর্মর করে ভেঙে গিয়েছে।

সেই মেয়েটি আজ পরলোকের পথে যাত্রা করেছে। গত তিন-চার বছর ধরে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত থাকার পর, আড়াই মাস আগে তার পাকস্থলীর ক্যান্সার ধরা পড়েছে এবং আজ সে তার রবের কাছে চলে গিয়েছে।

গত তিন-চার বছর তার সময়টা খুব অদ্ভুত এলোমেলো কেটেছে। কোথাও সে শান্তি খুঁজে পায়নি। বন্ধুবান্ধবরা তার সাথে দেখা করতে যায়, সে বান্ধবীদের বাসায় যাওয়া আসা করে, পড়াশোনা করার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো কিছুতেই সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে নি।

আমরা এভাবে কেন স্বপ্ন দেখি? আমাদেরকে ছোটবেলা থেকে শেখানো হয় তোমাকে এটা হতেই হবে, তোমাকে পারতেই হবে, তোমাকে কি কম খাওয়াই, কম খরচ করি তোমার পেছনে? এই যে এভাবে যখন আমাদের স্বপ্ন, উদ্দেশ্য, জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হয়; যখন আমরা সেটা পূরণ করতে পারি না তখনই হতাশায় ভেঙে পড়ি। যারা সৌভাগ্যবান তারা হয়ত স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পরেও নতুন স্বপ্ন নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। কিন্তু নতুন করে নতুন স্বপ্ন নিয়ে সবাই এগিয়ে যেতে পারে না।

দুনিয়াতে কিছু একটা পাওয়ার ইচ্ছা, কিছু একটা হতে পারার আকাঙ্ক্ষা- এটাই কেন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়? যেখানে দুনিয়ার জীবনটা খুবই সামান্য , খুবই ক্ষণিকের- যার উদাহরণ সমুদ্রের বিশাল জলরাশির মধ্যে আংগুল ডোবানোর পর, আঙ্গুলে উঠে আসা এক ফোঁটা পানির মতন!! সেই দুনিয়ার জীবনের লক্ষ্য পূরণ না হলে আমরা কেনো নিজেদের তিলে তিলে শেষ করে দেই?? আমাদের দুনিয়ার জীবনের সফল হবার আকাঙ্খা যেন আমাদের প্রাচুর্য, যশ-খ্যাতি ইত্যাদির জন্য নির্ভর করে!!!(যদিও সবাই একই রকম ভাবে চিন্তা করেনা)

“প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদিগকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে, যতক্ষণ না তোমরা সমাধিসমূহ দেখতে পাও (তোমাদের মৃত্যু হয়)। এটি কখনো সংগত নয়! অচিরেই তোমরা জানতে পারবে। আবারও বলি, এটি মোটেই সমীচীন নয়; তা তোমরা অনতিবিলম্বে জানতে পারবে। না, তোমাদের নিশ্চিত জ্ঞান থাকলে অবশ্যই তোমরা মোহগ্রস্ত হতে না। তোমরা (সময়ের প্রতি উদাসীন কর্মে অবহেলাকারীরা) অবশ্যই জাহান্নাম দেখবে (তাতে প্রবেশ করবে)। পুনশ্চ! অবশ্যই অতি অবশ্যই তোমরা জাহান্নাম চাক্ষুষ দেখে (তাতে প্রবেশ করে তার শাস্তি ভোগ করে) প্রত্যয় লাভ করবে। অতঃপর অবশ্যই সেদিন তোমাদিগকে প্রদত্ত সব নিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।’’ (সুরা ১০২ তাকাছুর, আয়াত: ১-৮)।

আমরা যদি অতি অল্পেই কৃতজ্ঞ হতে পারি, যা পাই তাতে যদি সন্তুষ্ট থাকি এবং আমাদের জীবনের লক্ষ্য যদি পরকালীন উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য হয়, তবে পাওয়া না পাওয়ার তীব্র হাহাকার অনেকখানি কমে যাবে। শুধুমাত্র অল্প কিছু অপূর্ণতা থেকে জীবনটাকে ধুকেধুকে শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছা তখন আর আমাদের মাথায় আসবে না, ইনশাআল্লাহ।

।।অনেক মানসিক কষ্ট এবং শারীরিক কষ্ট নিয়ে মিমি নামের বোনটি (আমার ছোট বোনের বান্ধবী) আজ আল্লাহর কাছে চলে গেছে। আল্লাহ তার গুনাহ খাতা মাফ করে দিন। তাকে জান্নাতের জন্য কবুল করে নিন। আমীন।।