আমার “মাতৃত্ব” যাত্রা

২০১৪ সালে, যখন প্রথম সন্তান গর্ভে আসে, আমি ও আমার অর্ধাঙ্গ দুইজনে বেশ আগ্রহ নিয়ে বেবিসেন্টার নামের একটা সাইট পড়তাম। গর্ভধারণের প্রতি সপ্তাহে শরীরে কোন পরিবর্তন আসে, কখন বাচ্চার হার্টবিট শুনতে পাব, মর্নিং সিকনেস কতদিনে কমবে এরকম শত প্রশ্নের উত্তরের জন্য বেবিসেন্টার ছিল আমাদের নির্ভরতার জায়গা।

এত অসাধারণ এই সাইটটা ব্রিটেনভিত্তিক, এবং স্বাভাবিকভাবে ইংরেজি ভাষার ওয়েবসাইট। আমার প্রথম মাতৃত্ব যাত্রায় বেবিসেন্টার নাবিকের ভূমিকা পালন করলেও আমাদের বারবার মনে পড়লো এই দেশের বেশিরভাগ মানুষের কথা, যারা গড়পড়তা ইন্টারনেট ব্যবহারকারি নন এবং ইংরেজি ভাষার সাইট পড়া তাদের জন্য বিশাল বাঁধা। অথচ সব পরিবারেই মেয়েরা মা হচ্ছেন, তাদের শত প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে মাতৃত্বের যাত্রা পাড়ি দিচ্ছেন অনিশ্চয়তায়।

গর্ভাবস্থার শেষের দিকে আমার মনে হলো, আমরা নিজেরাই এই লেখাগুলো অনুবাদ করে ফেলি না কেন! বাচ্চার বাবা টেকি মানুষ, আইডিয়া শেয়ার করায় জানালেন সাইট বানানো কঠিন না, তবে চালিয়ে নেয়া দুরূহ কাজ। কারণ আমরা দুজনেই চাকুরিজীবি।

সাত-পাঁচ না ভেবে আমরা ২০১৪ সালের অক্টোবরে একটা মাতৃত্ব ডট কম ডোমেইন নাম কিনে ফেলি। নভেম্বর মাসে সাইটে প্রথম লেখা প্রকাশ করা হয় “গর্ভধারণের ১০ টি প্রাথমিক লক্ষণ” শিরোনামে। বিগত বছরগুলোতে আমরা প্রায় ৩০০ লেখা প্রকাশ করলেও এই লেখা এখন পর্যন্ত মাতৃত্ব ডট কম’র বহুল পঠিত লেখা এবং গুগল সার্চে শীর্ষ ফলাফল।

এরপর একে এক আমরা এই উদ্যোগের ফেসবুক পাতাগ্রুপ চালু করি। মানুষের মাঝে গর্ভকালীন, গর্ভধারনের আগে পরের বিভিন্ন অবস্থা, শিশু পালন ইত্যাদি নানা বিষয়ে পড়াশুনার গুরুত্ব তুলে ধরতে ফেসবুক আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

আমাদের শুরুর সময়ে অনলাইনে এধরনের উদ্যোগ ছিলনা বললেই চলে। যদিও এখন এই কেন্দ্রিক লাভজনক-অলাভজনক নানা উদ্যোগ আছে, ২০১৪ সালে আমাদের মাতৃত্ব ডট কম শুরুর কারণ ছিল বাংলা ভাষায় এসংক্রান্ত কন্টেন্টের অভাব পূরণ। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে চলছিল আমাদের উদ্যোগ। ২০১৭ সালে আমার বিশ্ববিদ্যালয় সহপাঠী কানাডা প্রবাসী আফিফা রায়হানা মাতৃত্ব’তে লেখা শুরু করে। আমাদের উদ্যোগ যেন নতুন গতি পেল। ২০১৯ সালে ঢাবি’র আরেক সহপাঠি ছোটবোন রাবেয়া রওশীন মাতৃত্ব’তে যোগ দেন। তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে মাতৃত্ব একটা রূপ পেতে লাগল।

বেসরকারি কলেজের শিক্ষকতা, তিন সন্তান পালন, ঘর-সংসার এসবের মাঝেও প্রতিদিন-ই মাতৃত্ব’র কাজ চলতে থাকে, ভাললাগা ও ভালবাসার জায়গা থেকে। বাচ্চা ভালবাসি, বাচ্চার মায়েদের জন্য আমার মন আর্দ্র, তাই তাদের সচেতন করা, তাদের কঠিন সময়ে আলো হিসেবে কাজ করার জন্যই মাতৃত্ব ডট কম।

করোনাকালে যখন সবাই ডিজিটাল দুনিয়ায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছিল, মাতৃত্ব তখন ফেসবুকে আট হাজারেরও বেশি নারী ও মায়ের প্রশ্নের উত্তর পাবার জায়গা হয়ে উঠেছিল। আমাদের ফেসবুক গ্রুপের অনন্য দিক হলো শুধুমাত্র নারীদের গ্রুপ, যাতে সদস্যরা যেকোন প্রশ্ন করতে স্বাচ্ছন্য বোধ করেন। প্রতিটি সদস্য চুলচেরা নজরদারির মাধ্যমে গ্রুপে যোগ দেন, কারণ নারীর প্রাইভেসি আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এই বছর অক্টোবর থেকে আমরা মাতৃত্বের প্রিনাটাল কোর্স শুরু করছি। গর্ভবতী নারীদের জন্য জ্ঞানমূলক একটি ক্লাস যেখানে তারা তাদের পুরো গর্ভকালীন সময় সম্পর্কে জানবে, নরমাল ডেলিভারি এবং সি সেকশন সম্পর্কে বুঝতে পারবে, নিজেদের সুস্থতা, বাচ্চার সুস্থতা ইত্যাদি সম্পর্কে জানবে এবং বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পরে নিজেদের মানসিক যত্ন, শারীরিক যত্ন, বাচ্চার যত্ন ইত্যাদির বিষয়ে সেগুলো সম্পর্কে শেখানো হবে। আমাদের দেশে এই প্রিনাটাল ক্লাস এখনো খুব বেশি প্রচলিত নয়। তাই মাতৃত্ব থেকে আমরা কাজ করে যাচ্ছি এই জ্ঞানমূলক সেবা সবার কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য।

উপকারী জ্ঞান, আত্মবিশ্বাসী মা এই লক্ষ্য অর্জনে আমরা নিয়ে এসেছি “মাতৃত্ব প্রি-নাটাল কোর্স”

মাতৃত্বের যাত্রায় আমার প্রথম ও প্রধান সাথী আমার অর্ধাঙ্গ, যে কখনোই হাসাহাসি করেনি, কখনো ছেড়ে যায়নি, কোন বিনিময় আসছে না বলে সময় অপচয় মনে করে নি। বরং সবসময় সে আমার পাশে থেকেছে, উৎসাহ দিয়েছে, আমি থেমে গেলেও আবার চলার প্রেরণা জুগিয়েছে।

মাতৃত্ব প্রধান টীমের বাইরেও যাদের কথা না বললে অন্যায় হবে তারা হলেন আমাদের ডাক্তার বন্ধুরা, যারা মাতৃত্বের শতাধিক লেখা চেক করে দিয়েছেন যাতে কোন তথ্যগত ভুল না থাকে। তাদের এই স্বেচ্ছাশ্রমের প্রতিদান দেয়ার মতো কৃতজ্ঞতার ভাষা আমার জানা নেই।

উদ্যোগ হিসেবে মাতৃত্ব অলাভজনক ধাঁচের, তবে যেকোন উদ্যোগ হলো গাছের মতো, নিয়মিত পরিচর্যা ও বিনিয়োগ এর বেঁচে থাকা ও সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। মাতৃত্ব’র গল্প নিয়ে ২০২২ সালে আমি বিভিন্ন জনের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি, যাতে আরো বেশি সংখ্যক হাত একসাথে হয় আমাদের মিশনে।

বাংলাভাষী মানুষের কাছে মাতৃত্ব সংক্রান্ত কন্টেন্ট সহজলভ্য করার যেই লক্ষ্যে আমি কাজ শুরু করেছিলাম, তাতে অর্জন বেশ সামান্যই বলা চলে। তবে আমি হতোদ্যম নই, কারণ যদি আমাদের ছোট্ট প্রয়াস একজন মায়ের জন্য উপকারের কারণ হয়, তবে এটাই আমার পথচলার যথেষ্ট কারণ বলে মনে করি।