ছোট পুত্র খাওয়া নিয়ে বেশ ঝামেলা করে। মাঝে মাঝে দেখা যায় প্রায় সারাদিন মোটামুটি কোন কিছু না খেয়ে দিন কাটিয়ে ফেলে। একদিন তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলাম। প্রথম মাছ দিয়ে নিলাম, খেলোনা। আবার ডিম নিলাম, তাও খেলোনা। এরপর মুরগি দিলাম। সেটাও মুখ থেকে ফেলে দিচ্ছে। খুব বিরক্ত হচ্ছিলাম খাওয়াতে গিয়ে। পিটুনি দিয়ে যেহেতু রাগ কমাতে পারছিলাম না সেহেতু রাগ হয়ে তার সাথে আর কথা বলছিলাম না।
অফিস করে এসে শরীর বেশ ক্লান্ত তখন। খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিছানায় যাব কিছুক্ষণের জন্য। তার মধ্যে সে আনাড়িপনা করাতে একদম ভালো লাগছিলো না। কেন খাচ্ছো না, বলে বকা দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম তার কাছ থেকে। সে কেঁদে কেঁদে মা, মমি, মমি ডেকেই যাচ্ছিল। আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখলাম। আমি যেদিকে মুখ ফিরাই, সে সেদিকে চলে আসে আর জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। সে খাবেও না, আবার আমাকে আদর করতে হবে।দু তিন মিনিট তার কান্না চুপচাপ শুনলাম।
হঠাৎ করে বাবুই পাখিটার জন্য কষ্ট হতে লাগল। মন মেজাজ খারাপ হলে সেটা ঠিক করার জন্য অনেক ধরনের অপশন আছে আমার হাতে। কিন্তু বাচ্চাদের কাছে তাদের মা তো একজনই। সে যদি রাগ হয়ে কথা না বলে, তবে বাচ্চাটার কাছে কেমন কষ্ট লাগে!! মা কথা না বললে সে যে কমফোর্ট এর জন্য বাবার কাছে যাবে অথবা নানী দাদী কারো কাছে যাবে, তেমন কেউ তো আর বাসায় নেই। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তার একমাত্র কম্ফোর্ট তার এই মা।সাথে সাথে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিলাম। সরি বললাম।
পরবর্তী ঘটনা হলো, সে না খেলে সেটা নিয়ে এখন আর মাথা ঘামাই না। সপ্তাহে দুই তিন দিন ওর কিছু খেতে ইচ্ছা করে না। বাকি তিন চার দিন মেন্যু পছন্দ হলে মোটামুটি খায়। থাকুক এভাবে।
হাইপার বাচ্চা আমার। সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে চায়, কারো না কারো সঙ্গ চায়। কিছু না কিছু ভাঙ্গে, নষ্ট করে, চিৎকার করে, খেলে। সারাক্ষণ কারো না কারো নজর আশা করে। যখন তার সাথে থাকি তখন পাশাপাশি বড় দুই পুত্র কন্যার দিকে খেয়াল রাখার চেষ্টা করি। ওদেরকে কাছে ডেকে আদর দিয়ে দেই। যাতে করে ওদের মনে না হয় শুধু ছোট হওয়ার কারণে মা শুধু নুবাঈদকে ভালোবাসে।দুষ্টুমির জন্য বকা খায়। বকা দিয়ে পরে আবার বুঝিয়ে দেই, ঈমানে আমলে, আদবে ঘাটতি থাকলে বকা খাবে। মা বাবা শুধু শুধু কখনই বকাঝকা করবে না।
চারপাশে দেখেছি শুনেছি বুঝেছি, সন্তান যখন বেশ কয়েকজন হয় তখন কোন এক সন্তানের প্রতি মা-বাবার পক্ষপাত মূলক আচরণ দেখা যায়। কোন কোন বাসায় দেখা যায় সন্তানের পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, গায়ের রং ইত্যাদি কারণে অন্য সন্তানের চাইতে প্রাধান্য বেশি দেয় মা বাবা।কোথাও দেখা যায় ছেলে সন্তানের চাইতে মেয়ে সন্তানকে অথবা মেয়ে সন্তানের চাইতে ছেলে সন্তানকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। সেটা খাবারের ক্ষেত্রে হোক, আদরের ক্ষেত্রে হোক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হোক অথবা সম্পত্তি বন্টনের ক্ষেত্রে হোক। সবাইকে সমান নজরে দেখেনা অনেক মা-বাবাই।আমি কখনোই চাইনা বলতে আমার তিন সন্তানের মধ্যে ওমুক সন্তান সেরা। ওরা যাতে কখনো মা-বাবার পক্ষপাত মূলক আচরণে কষ্ট না পায় সেদিকে আমরা খুব চেষ্টা করি। প্রতিটি সন্তানই আমার সন্তান। একই রকম কষ্ট করে বড় করছি ওদের। সৃষ্টিগতভাবে ওরা প্রত্যেকে ই আচার-আচরণ, স্বভাব-বৈচিত্র্যে,বাহ্যিক সৌন্দর্যে, মেধায় আলাদা হবে। (স্বাভাবিক আদব কায়দা সবার একই রকম হবে এটা আশা করি।)।
ক্যারিয়ারের সবাই একই রকম ভাবে সফল হবে না। এখন আমি যদি ভালোবাসার মানদন্ডে ক্যারিয়ার, টাকা পয়সা, পড়াশোনা ফলাফল, ছেলে -মেয়ের শ্বশুর বাড়ি ইত্যাদিকে রাখি তবে এসব হবে নিচু মানসিকতা এবং ওইসব মা-বাবার সন্তান হবে হতভাগা।ছেলেমেয়েরা মা বাবার আদর ভালোবাসা চায়, সর্বোচ্চ মনোযোগটা চায়। পক্ষপাত মূলক আচরণ দেখে বড় হওয়া সন্তানেরা মা-বাবার প্রতি, মুরুব্বিদের প্রতি তাদের সম্মান ধরে রাখতে পারে না।সন্তান দুনিয়াতে আনা স্বাভাবিক জৈবিক একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু তাদের যথাযথ হক আদায় করে মানুষ হিসেবে বড় করাটাই হল মূল চ্যালেঞ্জ। .