এবার ঈদের সময় বেশ ব্যস্ততার সাথে কেটেছে। একা হাতে রান্না বান্না ,মেহমান সামাল দেওয়া ,বাচ্চাকাচ্চা সামলানো ইত্যাদি করতে গিয়ে ভালোই বেগ পেতে হয়েছে। ঈদের পরদিন আমার বাসাতেও মেহমান ছিল , আম্মুর বাসাতেও মেহমান ছিল। রাতে সব সেরে যখন আম্মুর সাথে কথা হচ্ছিল, আম্মু আমার জন্য বেশ মন খারাপ করছিল। ছানাপোনা নিয়ে একা হাতে কিভাবে এত কাজ করছি, তা ভেবে। আম্মুকে বলছিলাম, চিন্তা করিয়েন না । আমার দুটো জাদুর হাত আছে , আলহামদুলিল্লাহ।🤗

স্বাভাবিকভাবে অনেকেই প্রশ্ন করে থাকে, কিভাবে সময় ম্যানেজ করে কাজকর্ম করি? বিশেষ করে পিঠাপিঠি বাচ্চাদের মায়েদের এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা থাকে বেশি। যাদের আবার কোন ধরনের হেল্পিং হ্যান্ড নাই।

আজ আমি আমার সময় পরিকল্পনাগুলো কিছুটা শেয়ার করব।

করোনাকালীন সময়ে কাজের ধরন টা একটু ভিন্ন। এখন যেহেতু হোম অফিস করছি তাই সকাল 9 টা থেকে অফিসের কাজ শুরু হয় সাধারণত। ঘুম থেকে উঠে আগে ছোট পুত্রের খাবারটা বানিয়ে ফেলি। এরপর আমি আমার ক্লাসে ঢুকে যাই।
সকালের নাস্তা রুটি পরোটা ছাড়া আমাদের চলে না। অন্য খাবার খুব কমই খাওয়া হয়। মাঝেসাঝে হয়তো খিচুড়ি , ভাত ভাজি জাতীয় খাবার গুলো খাওয়া হয়। রুটি, পরোটা বানাতে যেহেতু বেশ সময় লাগে এবং প্রতিদিন সেটা বানানো আমার জন্য বেশ কষ্টসাধ্য, তাই আমি একসাথে কয়েকদিনের রুটি একসাথে রুটি মেকারে বানিয়ে রাখি। রুটি মেকারে বানানো রুটি হাতে বানানো রুটির মতো হয়তো এত পাতলা হয় না বা সুন্দর হয়না । তবে সময় কম লাগে এবং পরিশ্রম কম হয়। এছাড়া মাঝে মাঝে অনলাইনে ফ্রোজেন রুটি -পরোটা অর্ডার করি। এতে করেও এই কাজের প্রেসার কিছুটা কমে যায় এবং নতুনত্ব আসে।😊

মোটামুটি বারোটা নাগাদ অনলাইন ক্লাস শেষ হয় আমাদের তিনজনের। সাড়ে চার বছরের বড় পুত্র কখনো ক্লাস করে, কখনো করে না। জোর করি না ওকে। ছয় বছরের কন্যা ও তার ক্লাস গুলো একা একা করে। পাশে থেকে যে ক্লাস বুঝিয়ে দিব সেটা সম্ভব হয় না। মাঝেসাঝে সন্ধ্যায় ক্লাসের পড়া দেখিয়ে দিতে পারি। ক্লাস না বুঝলে ওরা বিরক্ত হয়, ক্লাস করতে চায় না তখন আর। কিন্তু কিছু করার থাকে না। ছোট মানুষ, আস্তে-ধীরে পড়ুক- এটা ভেবে নিজের কাজ করি। পড়ার বাইরে বিভিন্ন ধরনের বই নিয়ে ওদের সাথে ২০/২৫ মিনিট করে বসার চেষ্টা করি। বিভিন্ন রকমের গল্প করা হয় ওদের সাথে। ওদের কথা শুনি, ওদের মতামত বোঝার চেষ্টা করি(প্রতিদিন করার সময় হয়না)। দিনশেষে বুঝতে পারি বাচ্চারা তার মা-বাবাকে প্রতিটা কাজে অনেক বেশী খেয়াল করে এবং সেটাই অনুকরণ ও অনুসরণ করার চেষ্টা করে। তাই এমন কোন কিছু করি না যেটাতে আমাদের কথার সাথে কাজের মিল নাই।
এদিকে দেড় বছুরে ছোট পুত্র কে ওদের বাবা দেখে রাখে সকালের সময়টা। সে পারলে তিনজনের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। তিনজন মানুষ ওর সাথে কথাবার্তা বলছে না ,এটা সে সব সময় মেনে নেয় না। তাই প্রায় সময় ক্লাস এর মাঝখানে এসে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ‌।🥴

১২টার পর কাজ শেষ হলে কখনো-সখনো বাজার করতে যেতে হয়।এরপর টুকটাক রান্নাবান্না, ঘর গোছানো, খাওয়া-দাওয়া। রান্না শর্টকাটে সহজে যেটা করা যায় ,সেটা করার চেষ্টা করি। কখনো বেশি রান্না করে দু-তিনদিন খাই। সাধারণত ভাজি, তরকারি, ডাল এই জাতীয় খাবার থাকে। তরকারি কাটাকুটিতে বেশ সময় চলে যায়।(দেশের বাইরে ধোয়া কাটাকাটি করা সবজি পাওয়া যায়, আমাদের দেশেও ইদানিং পাওয়া যাচ্ছে। হয়তো কাজ সহজ করার জন্য কিছুদিন পরে আমরাও কাটা তরকারি কিনে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারি)
ঘর মপ দিয়ে মুছে ফেলি দু চার দিন পর পর। এরপর খাওয়া-দাওয়া শেষে ছোট পুত্র কে ঘুম পাড়ানো, সেই সাথে আমিও একটু বিশ্রাম নিয়ে নেই। বিকাল হলে তাকে নিয়ে আবার হাঁটতে বের হওয়া লাগে। কখনো আমি, কখনো ওদের বাবা ওকে নিয়ে বের হয়। বড় দুজন দুপুরে আরবি পড়ে এসে, বিকালে মাঠে চলে যায়। সবাইকে নিয়ে আমি যখন একটু হেঁটে আসি বাইরে থেকে, এটা একটা ম্যান্টাল রিফ্রেশমেন্ট হিসেবে কাজ করে।

এরপর সন্ধ্যার নাস্তা, ঘর গোছানো, বাচ্চাদের সময় দেয়া, রাতের খাবার, এক ফাঁকে কাপড়-চোপড় ধুয়ে ফেলা ইত্যাদি। তিন বাচ্চার জামা কাপড় মিলে প্রতিদিন অনেকখানি কাপড়-চোপড় হয় ধোয়ার জন্য। ওয়াশিং মেশিন ব্যবহারে এই কষ্টটা অনেকখানি দূর হয়েছে।
সারাদিনের কাজের অন্যতম একটা কষ্টকর অংশ হলো , থালা বাসন গুলো ধোয়া। ডিশ ওয়াশার এর ব্যবস্থা থাকলে এ কষ্টটাও কমে যেত। আপাতত রাত বারোটার পর ছোট পুত্র কে ঘুম পাড়ানো শেষ হলে, তারপর থালা বাসন মাজি, অফিসের কাজ করি, বাসাটা গুছাই। ফরয ইবাদত গুলো কোনরকম করার চেষ্টা করি। ল্যাকটেটিং মম হিসেবে ছোট জনকে দিনের অধিকাংশ সময় দেয়া লাগে। এতে শরীর ও মন বেশ ক্লান্ত থাকে।

কাজ সহজ করার জন্য যত ধরনের গেজেট ব্যবহার করা যায়, সাধ্যের মধ্যে চেষ্টা করি সেটা ব্যবহার করতে। বাচ্চাদের বাবা তাদের গোসল করানো এবং খাওয়ানো এই দুটো কাজ করে। অন্যান্য সময়গুলোতে মাঝেসাঝে সাহায্য করে। যেহেতু তাকেও বাসাতে বসে কাজ করতে হয় , তার নিজের কাজেও অনেক সময় দেওয়া লাগে। দিনশেষে চেষ্টা করি কাজ গুলো যত সহজে করা যায় এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে যাতে আমরা সবাই সুস্থ থাকি।

আমাদের প্রত্যেকের বাস্তবতা আলাদা। বাস্তবতা অনুযায়ী সংসারের জন্য, পরিবারের জন্য এবং নিজের জন্য আমাদের সময় দেয়া উচিত। একক পরিবার এবং যৌথ পরিবারে স্ট্রাগল গুলো এক রকম হয় না। যার যার ধরন বুঝে কাজ গুলো সহজ করে নেওয়া উচিত। এত কাজের ভিড়ে স্বামী ও সন্তানের সাথে সম্পর্ক গুলো যাতে ঠিক থাকে সেদিকে সর্বোচ্চ চেষ্টা দেয়া উচিত। সারাদিন কাজের প্রেসারে থেকে ঘর পরিপাটি রেখে দশ পদের খাবার বানিয়ে নিজের শরীরকে কষ্ট দেয়ার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। কাজ সহজ করার জন্য আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টাও তেমন জড়িত ,পাশাপাশি এর সাথে নিজের সুস্থতা, বাচ্চাদের সময় দেয়া ইত্যাদি বিষয়গুলোতেও অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন।

সাংসারিক কাজের প্রেসার সবসময় অনেক বেশি , অন্তত আমার কাছে বেশি মনে হয়। তিনজন পিঠাপিঠি ছোট বাচ্চা, যারা এখনো নিজের কাজ নিজে খুব একটা করতে পারেনা, তখন মনে হয় সারা দিনই কাজ করা লাগে এবং কোন সাহায্যকারীও নেই। তখন আমি এই হাদিসটা মনে করার চেষ্টা করি।

হজরত ফাতেমা (রা.) সাংসারিক সব কাজ সেবিকার সহযোগিতা ছাড়াই নিজে সম্পাদন করতেন। একদিন হজরত আলী (রা.) ঘরে এসে দেখেন যে, আটা পিষতে গিয়ে ফাতেমা (রা.)-এর হাতে ফোসকা উঠেছে। তিনি সেবিকা চাইতে তার পিতার (সা.) কাছে যেতে বললেন।
ফাতেমা (রা.) রাসুল (সা.)-এর দরবারে গিয়ে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সেবিকার আরজি পেশ করলে রাসুল (সা.) বললেন, ফাতেমা! তোমাকে কি আমি এর চেয়েও উত্তম কিছু দেব? ফাতেমা (রা.) বললেন, হ্যাঁ, ইয়া রাসুলাল্লাহ! তিনি বলেন, যখন তোমরা ঘুমোতে যাবে তখন ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আল-হামদুলিল্লাহ এবং ৩৪ বার আল্লাহু আকবার বলবে। তা তোমাদের জন্য সেবিকার চেয়েও উত্তম হবে- (বুখারি : ৩১১৩)।